প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় ( জামালপুর ) : চিকিৎসকরা সর্বত ভাবে প্রচেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে হার মানলেন ফেলুদা । ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকবাসী হলেন বাংলা চলচ্চিত্র ,নাট্য ও কাব্য জগতের নক্ষত্র ফেলুদা তথা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।
তাঁর প্রয়াণে শোকাতুর গোটা বাংলা। শোকাতুর পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের চকদিঘির বাসিন্দারাও ।চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে চকদিঘির জমিদারদের বাগানবাটিতে টানা বেশ কয়েকদিন ‘ঘরে বাইরে ’ ছবির শুটিং করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । সেই সময়ে প্রিয় শিল্পিকে একবার কাছ থেকে দেখতে নাওয়া খাওয়া ভুলে চকদিঘির বহু মানুষ পড়ে থাকতেন বাগানবাটিতে। তখন চকদিঘির কয়েকজন যুবক সত্যজিত রায়ের অনুরোধে ঘরে বাইরে ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন।আজ আর সৌমিত্র বাবু নেই । তবে সৌমিত্র বাবুর স্মৃতি রয়ে গেছে চকদিঘির বাসিন্দাদের । ইংরাজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব কালে এই বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন হয় । সেই সমসাময়িক কালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জামালপুরের চকদিঘির জমিদারদের নামও । দেশ স্বাধীন হবার পর জমিদারি প্রথা বিলিন হয়েগেলেও ১০০ বিঘা জমি জুড়ে থাকা চকদিঘির বাগান বাটি আজও সেই জমিদারি ঐতিহ্যের স্বাক্ষ বহন করে চলেছে । যার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে জমিদারি রাজত্বের নানা নিদর্শন । পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন চকদিঘির জমিদার পরিবারের সবথেকে কাছের মানুষ । এই জমিবার বংশের ক্ষ্যাতি শীর্ষে পৌছেছিল জমিদার সারদাপ্রসাদ সিংহরারের হাত ধরে । চকদিঘি বাগানবাটির পরিবেশ মুগ্ধ করেছিল খ্যাতনামা চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় মহাশয় কে । আশির দশকে তার পরিচালিত ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমার প্রায় পুরোটারই শুটিং হয়ছিল এই বাগান বাটিতেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ,ভিক্টর ব্যানার্জী , স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত প্রমুখ শিল্পীরা ঘরেবাইরে ছবির শুটিংয়ের জন্য চকদিঘির বাগানবাটিতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন ।সেই ছবিটি মুক্তি পাবার পর চকদিঘি জমিদার বাড়ির পরিচিতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ।
সত্যজিৎ রায়ের অনুরোধে ঘরে বাইরে ছবিতে পালকি বাহকের পার্শ্ব চরিত্রে চকদিঘি এলাকার যে চারজন অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সত্যজিৎ সেন । সেদিনের যুবক সত্যজিৎ সেন এখন সত্তরোর্ধ্ব। বয়সের ভারে তিনিও ভারাক্রান্ত ।
রবিবার বিকালে চকদিঘির বাগানবাটিতে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ সেন বলেন , সৌমিত্র বাবু আর বেচে নেই এই কথাটা ভাবতেই তাঁর কষ্ট হচ্ছে ।শুটিংয়ের সময়কার স্মৃতি রোমন্থন করে সত্যজিত বাবু বলেন ,টানা এক সপ্তাহেরও বেশি দিন বাগানবাটিতে শুটিং হয়েছিল । সেই সময়ে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায় ও পুত্র সন্দীপ রায় বাগানবাটিতেই থাকছিলেন। শিল্পী হিসাবে তাঁদের সঙ্গেই থাকছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় , স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত , ভিক্টর ব্যানার্জী সহ অন্য শিল্পীরা । জমিদারদের বাগানবাটির বৈঠকখানা ঘর জুড়েই নানা দৃশ্য গ্রহন হয়েছিল । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিত রায়কে একবার স্বচোক্ষে দেখার জন্য তিনি ও তাঁর বন্ধুরা নাওয়া খাওয়া ভুলে বাগানবাটিতেই তখন পড়ে থাকতেন ।ওই সময়েই সুদর্শন সুপুরুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কিছুটা হলেও কাছ থেকে দেখার ও সংলাপ শোনার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল । শুটিং দেখার জন্য বাগানবাটি জুড়ে প্রচুর মানুষ ভিড় জমাতেন । সত্যজিৎ সেন বলেন , “চকদিঘির জমিদারদের একটি বাড়ি তিনি দেখাশুনা করতেন । সেই সুবাদে সুটিং চলাকালীনও বাগানবাটির বৈঠকখানা ঘরের কাছে তিনি যেতে পারতেন । একদিন সৌমিত্র বাবু ও সত্যজিৎ রায় বৈঠকখানা ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন । তখন হঠাৎতই সত্যজিৎ রায় তাঁকে ডেকে বলেন , । ‘পালকি বাহকের পার্শ্ব চরিত্রে আমার কয়েকজন যুবককে দরকার । তুমি যোগাড় করে দিতে পারবে ? সত্যজিৎ সেন বলেন , প্রখ্যাত চিত্র পরিচালকের সেই কথায় আপ্লুত হয়ে তিনি ও গ্রামের আরও তিনজন পালকি বাহকের পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন ।’ এছাড়াও সত্যজিত রায় একদিন তাঁদের অনুরোধ করেছিলেন চেয়ারে বসিয়ে তাঁকে বৈঠকখানা ঘরের নিচ তলা থেকে উপরের তলায় নিয়ে যাবার জন্য । সেই অনুরোধও পূরণ করে ছিলেন বলে সত্যজিত সেন জানালেন । ”
বাগানগাটির লাগোয়া একটি বাড়িতে বসবাস করেন মধ্যবয়স্ক বধূ কাঞ্চন ঘোষ । তিনি জানালেন , ঘরে বাইরে সিনেমার সুটিং চলাকালীন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে একবার কাছ থেকে দেখার জন্য তিনি আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন । কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয় নি । তবে কিছুটা দূর থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে দেখতে পেয়েছিলেন । ওই দৃশ্যে ভিক্টর ব্যানার্জী ঘোড়ায় চাপছিলেন আর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সৌমিত্র বাবু । পরে বাগানবাটির অদূরে হয়েছিল একটি চালাঘর পোড়ানোর দৃশ্যের শুটিং । কাঞ্চনদেবী এদিন বলেন , সৌমিত্র বাবু মারা গেছেন শুনে চকদিঘি এলাকার সকল বাসিন্দাই মর্মাহত । তবে সৌমিত্র বাবুকে আজীবন মনে রাখবেন চকদিঘির আপামোর বাসিন্দা । ওনাকে ভোলার নয় ।